
ডিজিটাল যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এমন এক প্রযুক্তি, যা ব্যবসা ও চাকরির জগতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনছে। একসময় যে কাজগুলো মানুষের দক্ষতার ওপর নির্ভর করত, আজ তা দ্রুত, কম খরচে এবং সঠিকভাবে সম্পন্ন করছে এআই। শুধু তাই নয়, এআই কর্মক্ষেত্রে নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করছে, আবার কিছু চাকরিকে অচল করে দিচ্ছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি, ব্যবসার ধরণ এবং মানুষের পেশাগত ভবিষ্যৎ—সবকিছুতেই এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে।
ব্যবসায়িক খাতে এআই-এর প্রভাব-
ই-কমার্স ও গ্রাহকসেবা: ই-কমার্স খাত ইতোমধ্যেই এআই-এর সুবিধা নিচ্ছে। গ্রাহকের আচরণ বিশ্লেষণ, পণ্য সাজেশন, কাস্টমার কেয়ার চ্যাটবট—সবই এআই-এর ব্যবহার। উদাহরণস্বরূপ, অ্যামাজন বা আলিবাবার মতো প্ল্যাটফর্ম গ্রাহকের সার্চ হিস্টোরি ও কেনাকাটার অভ্যাস বিশ্লেষণ করে তাদের জন্য সঠিক প্রোডাক্ট সাজেস্ট করে। এর ফলে বিক্রি বাড়ছে এবং গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত হচ্ছে।
আর্থিক খাত: ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স সেক্টরে এআই ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতারণা সনাক্তকরণ, ক্রেডিট রিস্ক অ্যানালাইসিস এবং কাস্টমার সাপোর্টে। অনেক ব্যাংক এখন এআই-চালিত চ্যাটবট ব্যবহার করছে, যা ২৪ ঘণ্টা গ্রাহককে সহায়তা দিচ্ছে। আবার, মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম প্রতারণামূলক লেনদেন শনাক্ত করতে সাহায্য করছে, যা আগে কেবল মানুষের পর্যবেক্ষণে সম্ভব ছিল না।
স্বাস্থ্য খাত: চিকিৎসায় এআই নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। রোগ নির্ণয়, ওষুধ আবিষ্কার থেকে শুরু করে রোগীর চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি—সবখানেই এআই কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, এক্স-রে বা এমআরআই রিপোর্ট বিশ্লেষণে এআই মানুষের চেয়েও দ্রুত ও সঠিক ফলাফল দিতে সক্ষম হচ্ছে। এর ফলে চিকিৎসা সেবার মান বাড়ছে এবং খরচ কমছে।
উৎপাদনশীলতা ও অটোমেশন: ফ্যাক্টরিতে রোবট ও এআই-চালিত মেশিন ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে। মেশিনগুলো ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে পারে, যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে কম সময়ে বেশি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে এবং খরচও কমছে।
চাকরির বাজারে এআই-এর প্রভাব-
কিছু চাকরি হারিয়ে যাচ্ছে: ডেটা এন্ট্রি, কাস্টমার সার্ভিস কল সেন্টার, এমনকি অ্যাকাউন্টিংয়ের কিছু কাজ—যেখানে বারবার একই ধরনের কাজ করতে হয়, সেগুলো এআই সহজেই প্রতিস্থাপন করছে। উদাহরণস্বরূপ, আগে একটি বড় কল সেন্টারে হাজার হাজার মানুষ কাজ করত, কিন্তু এখন চ্যাটবট ও ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট দিয়ে একই কাজ করা সম্ভব হচ্ছে।
নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে: একদিকে কিছু কাজ হারিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে নতুন কর্মক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে। ডেটা সায়েন্টিস্ট, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার, এআই এথিক্স স্পেশালিস্ট, রোবোটিকস টেকনিশিয়ান—এসব নতুন ধরনের চাকরির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। তাই বলা যায়, এআই কেবল চাকরি কমাচ্ছে না বরং চাকরির ধরন বদলে দিচ্ছে।
দক্ষতা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা: ভবিষ্যতের চাকরির বাজারে টিকে থাকতে হলে শুধু প্রথাগত শিক্ষা যথেষ্ট নয়, প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য। প্রোগ্রামিং, ডেটা অ্যানালাইসিস, এআই টুল ব্যবহারের দক্ষতা—এসব এখনকার দিনে গুরুত্বপূর্ণ। আবার, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান ও নেতৃত্বের মতো মানবিক দক্ষতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ এগুলো এখনো এআই পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারেনি।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা-
বিশ্ব অর্থনীতির অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, এআই আগামী দশকে ব্যবসা-বাণিজ্যে "নতুন শিল্পবিপ্লব" তৈরি করবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এআই প্রযুক্তি বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ১৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোও এআই-এর মাধ্যমে বড় সুবিধা নিতে পারে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংকিং, এমনকি সরকারি সেবায় এআই যুক্ত করা গেলে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা উভয়ই বাড়বে। তবে এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ অবকাঠামো, নীতি সহায়তা এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে চাকরি ও ব্যবসার ধরণ আমূল বদলে দিচ্ছে। এটি যেমন ব্যবসাকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলছে, তেমনি চাকরির বাজারে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে। কেউ কেউ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছে, আবার কেউ নতুন সুযোগ পাচ্ছে। তাই এআই-এর এই পরিবর্তনকে ভয় না পেয়ে বরং প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করে নিজেদের মানিয়ে নেওয়াই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।