২০২৫ সাল একটি কঠিন ও হতাশাজনক বছর হিসেবে পার করলেন দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা। গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে পরিবর্তনের যে আবহ তৈরি হয়েছিল তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছিলো। দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত বাজার সংস্কার বাস্তবায়িত হবে, জবাবদিহিতা বাড়বে, আর্থিক খাত শক্তিশালী হবে এবং পুঁজিবাজার আরও স্বচ্ছ ও ন্যায্য হয়ে উঠবে—এমন আশাই ছিল বিনিয়োগকারীদের।
বাস্তবে ২০২৫ সালে কিছু কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মিউচুয়াল ফান্ডের নতুন বিধিমালা প্রণয়ন, মার্জিন ঋণের নিয়ম পরিবর্তন, নগদ লভ্যাংশ বিতরণ প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং বিও হিসাবের বার্ষিক ফি ৪৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫০ টাকায় নামানো হয়। পাশাপাশি বাজারে অনিয়ম ও কারসাজির অভিযোগে কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়, যা আগে খুব একটা দেখা যেত না।
তবে সংস্কারের এই যাত্রা শুরু থেকেই মসৃণ ছিল না। জোরপূর্বক শেয়ার বিক্রি, বিনিয়োগ প্রবাহ কমে যাওয়া এবং শেয়ারের দরপতনের কারণে বছরের শুরুতেই বহু বিনিয়োগকারী বড় ক্ষতির মুখে পড়েন। বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয় এবং বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যান—বাজার আদৌ ঘুরে দাঁড়াবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ বাড়তে থাকে।
সূচকের গতিপথেও এই অস্থিরতার প্রতিফলন দেখা যায়। বছরের শুরুতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ২০০ পয়েন্টের ওপরে। কয়েক মাসের ব্যবধানে তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। সেপ্টেম্বরে সূচক আবার কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ৫ হাজার ৬৩৬ পয়েন্টে উঠলেও ব্যাংক একীভূতকরণ এবং ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণার পর সূচক ফের ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে আসে।
বিশেষ করে আর্থিক খাতে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বড় আঘাত হানে। পাঁচটি ব্যাংক একীভূতকরণ এবং তালিকাভুক্ত নয়টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আটটিই বন্ধের পথে। ফেসভ্যালুর হিসাবে এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, অডিট রিপোর্ট ও ক্রেডিট রেটিং ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘদিনের আস্থাও নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
এছাড়া গত এক দশকে তালিকাভুক্ত হওয়া অনেক কোম্পানির পারফরম্যান্স ২০২৫ সালে এসে দুর্বল হয়ে পড়ে। একাধিক শেয়ার ‘দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় বাজার পরিস্থিতি আরও চাপের মুখে পড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত না হওয়ার বিষয়টি। পুরো বছরে একটি আইপিও না আসায় বিনিয়োগকারীদের সামনে ভালো মানের বিকল্প শেয়ারের সংকট তৈরি হয়।
লেনদেনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২০২৫ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দৈনিক গড় লেনদেন কমে দাঁড়ায় ৫১০ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের ৫৬৬ কোটি টাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বছর শেষে এসে বাজারে কোম্পানির আয় বা মুনাফার চেয়ে সংস্কার, পুনর্গঠন এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা নিয়েই প্রতিক্রিয়া বেশি দেখা যায়। এসব মিলিয়ে ২০২৫ সাল শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য কষ্ট, অপেক্ষা ও অনিশ্চয়তার বছর হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
