
বর্তমান বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির দুই নাম মার্কিন কোম্পানি টেসলা ও চীনের বিওয়াইডি (BYD)। ১৯৯৫ সালে ব্যাটারি প্রস্তুতকারক কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি সম্প্রতি বাংলাদেশের বাজারেও তাদের গাড়ি বিক্রি শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববাজারে দ্রুত বিক্রি বাড়ালেও বেশ কয়েকটি মডেল নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে রিকলে (Recall) নিতে হয়েছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা SAMR জানায়, বিওয়াইডির জনপ্রিয় মডেল Dolphin ও Yuan Plus–এর প্রায় ৯৭ হাজার গাড়ি রিকলে নেয়া হয়। কারণ—সিইপিএস ইউনিটের একটি প্লাস্টিক কাভারে ফাটল ধরার ঝুঁকি রয়েছে। ফাটল থেকে শর্ট সার্কিট হয়ে গাড়িতে আগুন লাগতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ত্রুটি প্রমাণ করে বিওয়াইডিকে এখনও গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে আরও সতর্ক হতে হবে।
তবে বিওয়াইডি দাবি করে তাদের ‘ব্লেড ব্যাটারি’ সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু বাস্তবে Han মডেলের একটি গাড়ি ক্র্যাশ টেস্টের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই আগুনে পুড়ে যায়। এছাড়া, অস্ট্রেলিয়ায় Atto 3 মডেলের এক গ্রাহক অভিযোগ করেন যে হাইওয়েতে ১০০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাকালে হঠাৎ ব্যাটারি বন্ধ হয়ে যায়। এসব ঘটনায় প্রমাণ হয়, ব্যাটারি সুরক্ষায় কোম্পানিটি এখনো কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।
বিওয়াইডির ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত দুর্ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের মে মাসে চীনের শেনজেনে। একটি Nissan GT-R স্পোর্টস কার উচ্চ গতিতে বিওয়াইডির e6 মডেলের ট্যাক্সিতে ধাক্কা দিলে গাড়িটি মুহূর্তেই আগুনে পুড়ে যায়। এতে চালক ও দুই যাত্রী নিহত হন। যদিও চীনা তদন্তে বলা হয়, মূল ব্যাটারি সেল পুরোপুরি ভেঙে যায়নি, তবে প্রচণ্ড ধাক্কার কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ইলেকট্রিক গাড়ির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়।
এদিকে মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল ২০১৯ সালের শাংহাই-তে যখন একটি Tesla Model S গ্যারেজে পার্ক করা অবস্থায় আগুন ধরে যায়। গাড়িটি স্ট্যান্ডবাই অবস্থায় ছিল, চালানো হচ্ছিল না এবং চার্জে ছিল না। আগুনের উৎস হিসেবে একটি ব্যাটারি মডিউল চিহ্নিত হয়। যদিও পুরো কোম্পানির তদন্তে ‘গাড়ি বা ব্যাটারি ডিজাইনে মৌলিক ত্রুটি নেই’ বলে বলা হয়েছে। তবে সেই ঘটনা টেসলার জন্য একটি বড় সতর্কতার সংকেত ছিল। এরপর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাটারি মডিউল সুরক্ষা বাড়ানোর কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের সড়কে ইতিমধ্যেই সীমিত পরিসরে বিওয়াইডির ইলেকট্রিক গাড়ি দেখা যাচ্ছে। তবে গ্রাহকদের মনে প্রশ্ন উঠেছে ঢাকার সড়কের জন্য এই গাড়িগুলো কতটা নিরাপদ? এছাড়া স্পেয়ার পার্টস ও সার্ভিস সাপোর্ট কি পর্যাপ্ত আছে? কারণ চীনসহ অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশে বিওয়াইডির গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন, গাড়িতে সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত সমাধান পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে স্পেয়ার পার্টসও দ্রুত পাওয়া যায়না। এমনকি হাইওয়েতে চলন্ত অবস্থায় ব্যাটারি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
অটোমোবাইল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বাজারে ইলেকট্রিক গাড়ি জনপ্রিয় হতে হলে নিরাপত্তা ও সার্ভিস নেটওয়ার্ক সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি ও ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল ইউনিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে মান নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। বিওয়াইডি যদি আন্তর্জাতিক বাজারের মতো বাংলাদেশেও রিকল বা সার্ভিসে ধীরগতি দেখায়, তবে গ্রাহক আস্থা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
ইলেকট্রিক গাড়ির ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল। তবে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও প্রযুক্তিগত ত্রুটির ঘটনা প্রমাণ করে শুধু বিক্রি না, ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই কোম্পানির প্রথম অঙ্গীকার হওয়া উচিত। বাংলাদেশের বাজারে বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রবেশ করলেও গ্রাহক আস্থা অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক মানের সুরক্ষা ব্যবস্থা, দ্রুত রিকল প্রক্রিয়া এবং কার্যকর গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত এসব গাড়ি অনুমোদনের আগে কঠোর নিরাপত্তা পরীক্ষা নিশ্চিত করা। অন্যথায় পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের পথে গ্রাহকদের আস্থা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।