বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত এখন নতুন এক প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে। আফ্রিকায় চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ দ্রুতই ওই মহাদেশকে উদীয়মান পোশাক উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত করছে। যা সরাসরি বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিল্প বিশ্লেষকরা।
চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন-আফ্রিকা বাণিজ্য রেকর্ড ২৯৫.৫৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে—যা টানা ১৬ বছর ধরে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে চীনের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে। তবে এবার শুধু বাণিজ্য নয়, চীন আফ্রিকায় সরাসরি উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করছে। বিশেষ করে টেক্সটাইল, পোশাক এবং হালকা শিল্পে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার সরবরাহকারীরা—বিশেষত বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম প্রতিযোগিতায় চাপের মুখে পড়ছে।
২০২৩ সালের শেষ নাগাদ আফ্রিকায় চীনা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের পরিমাণ ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বর্তমানে সেখানে ৩,৫০০টিরও বেশি চীনা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে টেক্সটাইল ও পোশাক উৎপাদন অন্যতম। ২০২৫ সালের জুনে চাংশায় অনুষ্ঠিত চীন-আফ্রিকা টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি কো-অপারেশন ফোরামে অংশ নেওয়া প্রতিনিধিরা আফ্রিকায় একটি স্বনির্ভর পোশাক শিল্পভিত্তি গড়ে তোলার ওপর জোর দেন—যেখানে তুলা চাষ থেকে শুরু করে স্পিনিং, বয়ন, রঙ করা এবং গার্মেন্ট উৎপাদন পর্যন্ত পুরো ভ্যালু চেইনটি আফ্রিকাতেই সম্পন্ন হবে।
মিশরের সুয়েজ খাল অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনের সহায়তায় গড়ে উঠছে ৮৩,০০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি ৪ কোটি ডলারের পোশাক শিল্প কমপ্লেক্স, যা চলতি বছরেই উৎপাদন শুরু করবে। এতে স্থানীয়ভাবে ১,২০০ জনেরও বেশি কর্মসংস্থান হবে বলে জানা গেছে। একইভাবে ইথিওপিয়া, কেনিয়া, নাইজেরিয়া এবং তানজানিয়াতেও চীনের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন শিল্পাঞ্চল ও পোশাক কারখানা গড়ে উঠছে। আফ্রিকার এসব দেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে কর ছাড়, স্বল্পমূল্যের জমি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান গ্রোথ অ্যান্ড অপরচুনিটি অ্যাক্ট (AGOA) অনুযায়ী পশ্চিমা বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিচ্ছে।
শিল্প বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী এক দশকে এই উন্নয়নগুলো বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্ডারে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক খুচরা বিক্রেতা এখন “চায়না-আফ্রিকা” কৌশল গ্রহণ করছে—যার মাধ্যমে তারা এশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আফ্রিকায় সরবরাহ শৃঙ্খল সংক্ষিপ্ত করতে চাইছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন দ্রুত অটোমেশন বৃদ্ধি, সরবরাহ ব্যবস্থার দক্ষতা উন্নয়ন, এবং উচ্চমূল্যের পণ্যে (যেমন স্পোর্টসওয়্যার, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল ও টেকসই ফ্যাশন) সম্প্রসারণ। অন্যথায়, বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যগত “লো-কস্ট ম্যানুফ্যাকচারিং” সুবিধা হারাতে পারে, কারণ আফ্রিকার দেশগুলো শুধু সস্তা উৎপাদক নয়, রাজনৈতিকভাবে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবেও আবির্ভূত হচ্ছে।
তবে অনেক অর্থনীতিবিদ এটিকে সম্ভাবনার দিক থেকেও দেখছেন। তাদের মতে, চীনের আফ্রিকান উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য নতুন যৌথ বিনিয়োগ (Joint Venture) সুযোগ তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের উৎপাদন অভিজ্ঞতা এবং আফ্রিকার কাঁচামাল ও পশ্চিমা বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার—এই দুইয়ের সমন্বয়ে উভয় পক্ষই লাভবান হতে পারে।
সার্বিকভাবে, আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগ বিশ্ব পোশাক বাজারে নতুন ভারসাম্য তৈরি করছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একদিকে বড় চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে কৌশলগত অংশীদারত্বের এক নতুন দরজাও খুলে দিচ্ছে।
