
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে গভীর অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব হয়তো মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তবে বিশ্বায়িত বাজারব্যবস্থার যুগে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও এই সংঘাত থেকে নিরাপদ নয়। বিশেষ করে তেল আমদানির ওপর নির্ভরতা, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী শ্রমিক, বৈদেশিক বাণিজ্য ও রপ্তানি—সবমিলিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশ গল্ফ অঞ্চলের দেশগুলো থেকে তেল আমদানি করে। ইরান–ইসরায়েলের যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল সরবরাহে ঝুঁকি তৈরি হবে এটা স্বাভাবিক। যার ফলে তেলের দাম বাড়বে এটা প্রায় নিশ্চিত। ইতোমধ্যে “Brent crude” ও “WTI” তেলের দাম ১–৭ % বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি হরমুজ প্রনালী বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে ব্যারেল প্রতি দাম ৯০–১২০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে।
এই মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি বাংলাদেশের উপর প্রভাব ফেলবে। এতে উৎপাদন, পরিবহণ, কৃষি–চালনায় খরচ বেড়ে যাবে, যা জরুরি পণ্য ও সেবার দাম বাড়াবে।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০২৪ সালে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। চলমান যুদ্ধ গালফ অঞ্চলে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও বাহ্যিক ভ্রমণ বিধিনিষেধের সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতের মতো দেশে—যেখানে লাখ লাখ বাংলাদেশী প্রবাসী কর্মরত রয়েছেন—কাজ হারানো বা দেশে প্রত্যাবর্তনের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। যা পরবর্তীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। রেমিট্যান্স হ্রাস বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়াবে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় উভয় হ্রাস পেলে রিজার্ভ আরও সংকুচিত হবে, যা টাকার অবমূল্যায়ন ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি থেকে গার্মেন্টস খাতের অংশ প্রায় ৮০ – ৮৩% । যুদ্ধ জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ও রেড সি–এর শিপিং ঝুঁকিতে পড়তে পারে, এর ফলে শিপিং খরচ ও সময় বৃদ্ধি পাবে । ফলশ্রুতিতে রপ্তানি লাভের মার্জিন সংকুচিত হবে।
জ্বালানির দাম বাড়লে কৃষি মেশিন, সেচ ও পরিবহণ ব্যয় বেড়ে যায়। খাদ্য ও কৃষিপণ্য মুল্য বৃদ্ধি পায়, যা নিত্য প্রয়োজনের বাজারে প্রভাব ফেলবে। উচ্চ দামের জ্বালানি ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে পেমেন্ট ডিফল্ট ও ঋণের ঝুঁকি বাড়বে, যা ইতিমধ্যেই উচ্চ মাত্রার নন-পারফর্মিং লোন নিয়ে সংগ্রাম করছে ব্যাংকিং সেক্টরকে সংকটাপন্ন করবে ।
ইরান–ইসরায়েল সংঘর্ষ অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরকে প্রভাবিত করছে। দাম, সরবরাহের চাপ, রেমিট্যান্স পরিবর্তন, বাণিজ্য-বিপত্তি—–এসব সঙ্কট একসঙ্গে যুক্ত হলে জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও ভোক্তা জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে। প্রশাসনিক প্রস্তুতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্তৃপক্ষের সক্রিয় নীতি এবং সরকারের অর্থনৈতিক সাক্ষর আয়োজন ছাড়া পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এখন সময়—দূরদর্শিতা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং কার্যকর বাস্তবায়ন— যাতে বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক ঝড় থেকে রক্ষা পেতে পারে।