
ছোট ছোট ভিডিও বানিয়ে মুহূর্তেই ভাইরাল হওয়ার স্বপ্নে মেতে উঠেছে দেশের কিছু তরুণ-তরুণী। কিন্তু এই বিনোদনের আড়ালে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও সামাজিক শৃঙ্খলা।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে টিকটকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটির বেশি। প্রতি মিনিটে কেউ না কেউ গান, নাচ বা সংলাপের ভিডিও আপলোড করছে চীনা এই প্লাটফর্মে। কিন্তু এসবের বড় অংশই আমাদের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতিকে ধারণ না করে বিকৃত করছে। গ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান, পালাগান বা বাউল সংগীতের জায়গায় হিন্দি বা পশ্চিমা গানের লিপসিং ভিডিও প্রকাশ করা হচ্ছে। অনেক সময় এসব ভিডিওতে অশালীন ভঙ্গি, অপ্রাসঙ্গিক পোশাক বা অযথা শরীর প্রদর্শনও থাকে, যা সামাজিকভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করছে।
চলতি বছরের অগাস্টে ঢাকার ধামরাইয়ের পৌর শহরে টিকটক ভিডিও বানাতে গিয়ে গলায় ফাঁস লেগে হরেক মণ্ডল (১২) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, হরেক মণ্ডল নিজ ঘরে টিকটক ভিডিওতে ফাঁসির দৃশ্য অভিনয় করতে গিয়ে সে গোসলের বালতির ওপর দাঁড়িয়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে অভিনয় শুরু করে। হঠাৎ পায়ের নিচ থেকে বালতিটি সরে গেলে তার গলায় ফাঁস লেগে শ্বাসরোধ হয়ে যায়। পরে পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এর আগে ২০২১ সালে নারায়ণগহগঞ্জের পাইকপাড়া এলাকায় আনিল নামে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর দুই বন্ধুকে নিয়ে নির্মাণাধীন একটি তিনতলা ভবনের ছাদে টিকটকের জন্য ভিডিও বানাতে যায়। ভিডিও বানানোর এক পর্যায়ে ছাদ থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বলছে, টিকটক ভিত্তিক গ্যাং সক্রিয়তার সঙ্গে নানা অপরাধ জড়িত।
এছাড়া, টিকটকের প্রভাবে ভাষা ও আচরণেও দেখা দিয়েছে পরিবর্তন। অনেক তরুণ এখন বাংলার সাথে অন্যান্য ভাষা মিশিয়ে কথা বলছে। টিকটকে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুম বা ধর্মীয় স্থানেও ভিডিও বানাচ্ছে। যা সংস্কৃতিগত শালীনতার পরিপন্থী। তাই অভিভাবকদের এখনই এ বিষয়ে নজর দিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। টিকটক এক ধরনের সংস্কৃতি তৈরি করছে, যেখানে ভাবনা বা মূল্যবোধের চেয়ে লাইক, ভিউ ও ফলোয়ারই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বিনোদন মাধ্যমের আড়ালে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে টিকটকের বিরুদ্ধে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকটক ব্যবহারকারীর ফোনের ক্যামেরা, কনট্যাক্ট লিস্ট, অবস্থান, এমনকি কী-স্ট্রোক (টাইপিং আচরণ) পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে থাকে। যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য গুরুতর হুমকি।
মার্কিন সাইবার সিকিউরিটি সংস্থা ইন্টারনেট ২.০ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, টিকটকের অ্যাপটি এমন অনেক অনুমতি নেয় যা ভিডিও অ্যাপের জন্য প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, এসব তথ্য মূলত চীনা সরকার বা তাদের অংশীদার প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে পারে। যেহেতু টিকটকের মূল কোম্পানি বাইটড্যান্স চীনা মালিকানাধীন।
এই উদ্বেগের কারণে টিকটক ইতিমধ্যে ভারত, নেপাল, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, সেনেগাল, কিরগিজস্তানসহ একাধিক দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারি অফিসগুলোতেও নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় সরকারি কর্মচারীদের ফোনে টিকটক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জনপ্রিয়তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই তথ্য-সংগ্রহ প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে আরও সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই টিকটক ব্যবহারে সচেতনতা ও বিকল্প নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।