পি-তে পিস, এইচ-তে হ্যাপিনেস, এবং পি-তে প্রসপারিটি। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধি। গল্পটা ব্যবসার জগতে সফল এক কিংবদন্তী সুফী মিজানুর রহমানের। তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান পিএইচপি পরিবারের কর্ণধার। তার জীবনজুড়ে বিস্ময়কর উত্থানের গল্প।
মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন এই সফল ব্যবসায়ী। এখন তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ১০ হাজার মানুষ। আর তার প্রতিষ্ঠান পিএইচপি দেশে বিনিয়োগ করেছে ২৩টির বেশি খাতে।
সহজ-সরল, বিনয়ী ও মিষ্টভাষী একজন মানুষ। এক কথায় ভীষণ মিশুক। কথা বলতে গেলেই কখনো উদাহরণ টানেন পাশ্চাত্যের জ্ঞানগুরুদের, কখনো ইসলামের কালজয়ীদের, কখনো বা মানবধর্মের মহামানবদের। নিজেও জীবনযাপন করেন সৎ ও সত্যতার নিরেট এক প্লাটফরমে। খুঁজে বেড়ান জীবনের মানে। মানুষটিকে কেউ ডাকেন সুফি সাহেব, কেউ বা মিজান সাহেব।
গল্পের শুরুটা ১৯৬৪ সাল। নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী সুফী মিজানুর রহমান। তখনই জীবিকার খোঁজে কাজে ঢুকে পড়েন নারায়ণগঞ্জের জালাল জুট ভ্যালি কোম্পানিতে। বেতন ১০০ টাকা। পরের বছর বি.কম পড়াকালীন ১৬৭ টাকা বেতনে তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক) চট্টগ্রামের লালদীঘি শাখায় জুনিয়র ক্লার্কের সরকারি চাকরি নেন। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (বর্তমানে পূবালী ব্যাংক) চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় জুনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় ভাতা পেতেন ৮০০ টাকা। ৪৬ বছরের ক্যারিয়ারের সাত বছর ব্যাংকারের জীবন শেষে ১৯৭২ সালে প্রবেশ করেন ব্যবসায়।
ব্যবসা করবেন বলেই ছেড়ে দিলেন চাকরি। কিন্তু চাইলেই তো আর ব্যবসা শুরু করা যায় না। ব্যবসার জন্য প্রয়োজন পুঁজি। তিনি পুঁজি পাবেন কোথায়? সেই সময়ের স্মৃতি সুফী মিজানের মুখে: ‘চাকরি জীবনের শুরুতে ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় কাজ করতাম। নিজের ব্যাংকের ক্ষতি না করে একজন আমদানি ও রপ্তানিকারক যাতে সর্বোচ্চ সুবিধা পায় এবং আয় করতে পারে সেই চেষ্টাই করতাম সব সময়। এর বিনিময়ে আমি তাদের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিইনি কখনো। চাকরি ছেড়ে যখন আমি ব্যবসায় এলাম তখন ওই সব আমদানি-রপ্তানিকারকরাই আমাকে বাকিতে পণ্য দিয়ে সহায়তা করতে লাগল। ব্যাংকের টাকা সময়মতো শোধ করতাম। সে কারণে আমার প্রতি ছিল বিভিন্ন ব্যাংকের গভীর আস্থা। এভাবেই আমার যাত্রা শুরু ও এগিয়ে চলা।’
ব্যবসার শুরুর দিকে চট্টগ্রামের ইলিয়াছ ব্রাদার্স, জাকারিয়া ব্রাদার্স, মেসার্স ইমাম শরীফ ও ডায়মন্ড করপোরেশন থেকে চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবণ, গম ট্রাকে করে ঢাকার পাইকারি বাজার ও মৌলভীবাজারে নিজে নিয়ে বিক্রি করতেন। বিক্রি শেষে নিজের লাভের টাকা রেখে তাদের পণ্যের দাম পরিশোধ করতেন। এভাবে সুফী মিজানের প্রতি তাদের আস্থা বেড়ে যায়। দেশ স্বাধীনের পর রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। সব কিছুরই অভাব ছিল। ঢাকায় পণ্য পৌঁছতে সময় লাগত সাত-আট দিন। সুফীর কেনা পণ্য ঢাকায় পৌঁছার আগেই বাজারে দাম বেড়ে যেত।
১৯৭২ সালে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ব্রিজস্টোন টায়ার আমদানি করেছিলেন জাপান থেকে। বিনিয়োগ ছিল চার হাজার ডলার। সে সময় প্রতি ডলারের মূল্যমান ছিল ১১ টাকা। অর্থাৎ ৪৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লাভ করেছিলেন এক লাখ টাকা। সুখ স্মৃতি মনে পড়ায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার মুখ। বলেন, ‘এত টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়ার পর স্ত্রী হতবাক হয়ে যায়। আমাকে প্রশ্ন করে, কোথায় পেলাম এত টাকা? ঘরে টাকা রাখার জায়গা ছিল না, রেখেছিলাম মুড়ির টিনে।’
১৯৮২ সাল। দেখলাম নিত্যপণ্য আমদানির ব্যবসায় সারাবিশ্বে মন্দা চলছে। হিসাব করে দেখলাম আমার হাতে তখন প্রায় ২০ কোটি টাকা জমে গেছে। প্রথম সীতাকুণ্ডের বঙ্গোপসাগর উপকূলে শিপইয়ার্ড দিলাম। ‘ওশান এসি’ নামে একটি পুরনো জাহাজ এনে কেটে বিক্রি করে লাভ পেলাম দুই কোটি টাকা। লাভের পর দিলাম রি-রোলিং মিল। তারপর ১৯৮৪ সালে মংলা ইঞ্জিনিয়ার্স ওয়ার্কস নামে দেশের প্রথম বিলেট তৈরির কারখানা দিলাম। তাতেও দেখছি অনেক লাভ। এভাবেই প্রথম শিল্প স্থাপনের গল্প শোনান সুফী মিজান।
১৯৮৬ সালে ঢাকায় ঢেউটিনের কারখানা স্থাপন করেন সুফী মিজান। সব মিলিয়ে তখন তার আটটি কারখানা। স্ত্রী বললেন, সব শিল্পকারখানা কি ঢাকায় করবেন, চট্টগ্রামে কিছু করবেন না? কারণ সুফী থাকতেন চট্টগ্রামে। স্ত্রীর ইচ্ছাকে মাথায় রেকে ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামের কুমিরায় স্থাপন করেন সিআর কয়েল কারখানা। এবং একই বছরের ২২ জুলাই প্রতিষ্ঠা করেন আজকের পিএইচপি গ্রুপ।
সুফী মিজান স্বপ্ন দেখেন, পিএইচপিতে যারা কাজ করবেন তাদের সবার থাকবে বাড়ি-গাড়ি। তিনি বলেন, ‘ঋণ দেব, জমি দেব, ফ্ল্যাট বানিয়ে দেব। আমাদের গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সুইপার পর্যন্ত সবার মুখে হাসি দেখবেন। এখানে কাজটাকে তারা উপভোগ করেন। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেলে তার পরিবার স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত আমাদের গ্রুপ তাদের সহায়তা দেয়। একটি উদাহরণ দিই। আয়ুব নামে একজন কর্মকর্তা মারা গেছেন। গ্র্যাচুইটি প্রভিডেন্ট ফান্ড ছাড়াও কোম্পানি তার পরিবারকে ব্যবহারের জন্য গাড়ি দিয়েছে। মাসিক এক লাখ টাকা করে ভাতাও দেয়।
তিনি বলেন, ভারতীয় টাটা হলো বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় লৌহজাত সামগ্রীর শিল্প-প্রতিষ্ঠান। পিএইচপি বাংলাদেশে তেমনি খনির আকরিক লোহা থেকে একদম শেষ পণ্য বানানোর কারখানা গড়বে।
ব্যাক্তি জীবনে তিনি সাত ছেলে এক মেয়ের পিতা। বড় ছেলে মো. মোহসিন পিতার মতোই দেশসেরা একজন শিল্পোদ্যোক্তা। তার অন্য ভাইবোনেরা হলেন ইকবাল হোসেন, আনোয়ারুল হক, আলী হোসেন, আমির হোসেন, জহিরুল ইসলাম, আক্তার পারভেজ হিরু ও ফাতেমা তুজ-জোহররা। তাদের মা তাহমিনা রহমান।
বর্ষীয়ান এ ব্যবসায়ী মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও হিন্দি, উর্দু, ফার্সি, আরবি, ইংরেজিসহ ছয়টি ভাষায় কথা বলতে পারেন। ঢাকার কাঞ্চননগর গ্রামে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন। মাত্র পাঁচ টাকায় সেখানে রোগীদের দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের আসকারদীঘি পাড়ে মাউন্ট হাসপাতালসহ শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য ‘ইউআইটিএস’ গড়ে তুলেছেন তিনি।
Divine Blessings Mixed with Hard Work Backed by Good Intension can Make Miracle— এই মন্ত্রেই বিশ্বাসী সফল ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এ সত্যকেই ভিতরে লালন করে তিনি বলেন, আপনি যদি আল্লাহর দয়া পেতে চান, তবে আপনাকে একজন ভালো মানুষ হতে হবে। আপনাকে পরোপকারী হতে হবে। ধার্মিক হতে হবে। হতে হবে সৎ, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক। তবে তা কাউকে দেখানো কিংবা বাহ্বা পাওয়ার জন্য নয়, মনের গভীর থেকে। নিজেকে কাজের মধ্যে উজাড় করে দিতে হবে। আর যে মানুষ যত বেশি মানুষের জন্য কাজ করে, বিধাতা তাকে তত বেশি বড় করেন।