
ইসরায়েল এমন একটি দেশ যার অস্তিত্বের শুরু থেকেই যুদ্ধ এবং নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে। দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও শক্তিশালী গোয়েন্দা কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয় ইসরায়েলের গোয়েন্দা ত্রয়ী—মোসাদ, শিন বেত ও আমান। প্রতিটি সংস্থা নিজস্ব কার্যক্রম ও কাঠামো অনুযায়ী কাজ করলেও, সম্মিলিতভাবে তাদের মূল লক্ষ্য হলো দেশকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকি থেকে রক্ষা করা।
এই সংস্থাগুলো শুধু তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণই করে না, তারা সরাসরি অভিযান পরিচালনা, সাইবার প্রতিরক্ষা এবং এমনকি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেও অংশ নেয়। এসব সংস্থাগুলো সময়মতো আগাম বার্তা দিয়ে, লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে কিংবা গোপন অভিযান চালিয়ে সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করে থাকে।
মোসাদ (Mossad)
বিশ্বের অন্যতম রহস্যময় ও দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে পরিচিত মোসাদ হলো ইসরায়েলের প্রধান বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা। যার পূর্ণ নাম "HaMossad leModiʿin uleTafkidim Meyuḥadim", অর্থাৎ “গোয়েন্দা ও বিশেষ অভিযানের জন্য সংস্থা”। মোসাদের মূল দায়িত্ব হলো বিদেশে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করা, শত্রু রাষ্ট্র বা সংগঠনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজন হলে গোপনে অভিযান পরিচালনা করা।
প্রধান দায়িত্ব
- বিদেশি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ: ইরান, সিরিয়া, লেবাননসহ তাদের শত্রু রাষ্ট্রগুলোর সামরিক, পরমাণু এবং রাজনৈতিক তথ্য সংগ্রহ করা।
- অভিযান: হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইসলামিক জিহাদ নেতাদের টার্গেট করে গোপন হত্যাকাণ্ড চালানো।
- অপহরণ ও গুপ্ত অভিযান: ইতিহাসখ্যাত নাৎসি যুদ্ধাপরাধী আদলফ আইনসম্যানকে ১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে ইসরায়েলে আনা হয়।
- মনস্তাত্ত্বিক ও প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ: শত্রুদের বিভ্রান্ত করতে ভুয়া তথ্য ছড়ানো ও গণমাধ্যম ব্যবহার করে কৌশলগত লাভ আদায়।
মোসাদ সরাসরি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে রিপোর্ট করে। সংস্থাটির কার্যক্রম অত্যন্ত গোপনীয় এবং এর সদস্যদের পরিচয় সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। মোসাদের একটি বিশেষ অপারেশন ইউনিট রয়েছে – “কিদন” (Kidon) – যারা গুপ্তহত্যা ও সরাসরি অভিযান পরিচালনায় নিযুক্ত।
সম্প্রতি মোসাদ ইরানের পরমাণু প্রকল্পে জড়িত বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে টার্গেটেড অপারেশন চালিয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশে হামাস নেতাদের নিঃশব্দে হত্যার ঘটনাও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচিত।
মোসাদ ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব রক্ষায় অন্যতম শক্তি। এর দক্ষতা, গোপনীয়তা ও নির্ভুল অপারেশন বিশ্বের অনেক গোয়েন্দা সংস্থার জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত।
আমান (Aman) — সামরিক গোয়েন্দা
আমান হলো ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, যা প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাধারণ সদর দপ্তরের অধীনে কাজ করে। এই সংস্থার মূল কাজ হলো তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সামরিক কমান্ডকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা। তবে ইসরায়েলে গোয়েন্দা সংস্থার ইতিহাস ইসরায়েলের অস্তিত্বের চেয়েও পুরোনো। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ‘শাই’ নামে একটি গোয়েন্দা সংস্থা এখানে কাজ করতো। আমান বেশ কয়েকটি ইউনিট নিয়ে গঠিত, তবে ৮২০০, ৯৯০০ এবং ৫০৪ হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট, যারা গাজায় ইসরায়েলের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে।
গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার আগে সংবাদমাধ্যমে এমন খবরও প্রচারিত হয়েছিল যে, ইসরায়েল তাদের গোয়েন্দা বাহিনীর আওতায় নতুন একটি ইউনিট যুক্ত করেছে, যার নাম ‘ব্রাঞ্চ ৫৪’। এই ইউনিট সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘ব্রাঞ্চ ৫৪’ ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের অধীনে কাজ করবে এবং এর দায়িত্ব হবে ইরান ও বিশেষ করে ‘পাসদারান-ই-ইনকিলাব’ (ইরানি বিপ্লবী গার্ড)-এর সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া।
শাবাক (Shabak) বা শিন বেট (Shin Bet)
শাবাক, যেটি সাধারণত শিন বেট (Shin Bet) নামে পরিচিত, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা। এর পূর্ণ নাম “Sherut ha-Bitachon ha-Klali”, যার বাংলা অর্থ “সাধারণ নিরাপত্তা পরিষেবা”। এটি ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এবং মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ, চক্রান্ত, রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা ও গুপ্তচরবৃত্তির বিরুদ্ধে কাজ করে।
প্রধান দায়িত্ব
- অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস প্রতিরোধ: ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী, হামাস, ইসলামিক জিহাদ প্রভৃতি সংগঠনের হামলা রোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
- গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ: পশ্চিম তীর, গাজা ও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বসবাসরত সন্দেহভাজনদের ওপর নজরদারি চালায়।
- উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা: ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রীয় নেতাদের নিরাপত্তা শিন বেতের দায়িত্বে।
- সাইবার নিরাপত্তা: অভ্যন্তরীণ সাইবার হামলা ও হ্যাকিং প্রতিরোধে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে।
শিন বেতের সদরদপ্তর তেল আবিবে অবস্থিত। সংস্থাটির প্রধানকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন এবং তিনি জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রিসভায় দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন। এর বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে, যেমন:
- আরব ইউনিট: আরব-সম্পর্কিত হুমকি ও সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে নজরদারি
- নন-আরব ইউনিট: বিদেশি ও ইসরায়েলি নাগরিকদের সম্ভাব্য হুমকি পর্যবেক্ষণ
- সুরক্ষা ইউনিট: সরকারী ভবন, বিমানবন্দর ও কূটনৈতিক মিশনে নিরাপত্তা
১৯৯৫ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইৎসহাক রবিনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিন বেত সমালোচিত হয়, কারণ তারা আগেভাগে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে সংস্থাটি বড় ধরনের সংস্কার ও আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে কার্যকারিতায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটায়। শিন বেত ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী একটি প্রতিষ্ঠান। অভ্যন্তরীণ হুমকি প্রতিরোধে তাদের সফলতা দেশটিকে সুরক্ষিত রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে।
ইসরায়েলের সমন্বিত গোয়েন্দা কাঠামো—আমান, মোসাদ ও শিন বেত—একযোগে কাজ করে দেশের সুরক্ষা-জাল তৈরি করে। প্রতিটি সংস্থা নিজ নিজ অবকাঠামো, ক্ষমতা ও ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণে নিযুক্ত। তাদের যৌথ উদ্যোগ, প্রযুক্তিগত আধুনিকতা ও গোপন নেটওয়ার্ক ইসরায়েলের নিরাপত্তার মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে আসছে, যদিও রাজনৈতিক প্রভাব ও তথ্যগত দুর্বলতা প্রতিনিয়ত নতুন চ্যালেঞ্জ উত্থাপন করে।