ঢাকা     ২৪ জুলাই ২০২৫ ||  ৯ শ্রাবণ ১৪৩২

Biz Tech 24 :: বিজ টেক ২৪

এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:০১, ২২ জুলাই ২০২৫

এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা

রাজধানী উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হয়েছেন। সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে বিমানটি উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পর মাইলস্টোন স্কুলের ভবনের ওপর আছড়ে পরে। এই দুর্ঘটনার পর চীনের তৈরি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এই যুদ্ধবিমানের কোন ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে তা তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে। 

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অন্যতম কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য ছিল এই এফ-৭ বিজিআই (F-7BGI) যুদ্ধবিমান। দীর্ঘ সময় ধরে আকাশ প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এই বিমানটি চীনের Chengdu Aircraft Corporation কর্তৃক নির্মিত একটি উন্নততর মিগ-২১-এর সংস্করণ। এটি মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের ভিত্তিতে তৈরি, তবে চীন এটি নিজেদের প্রযুক্তিতে আধুনিকায়ন করে বিভিন্ন মডেলে রপ্তানি করে আসছে। এর মধ্যে বিজিআই সংস্করণটি সবচেয়ে উন্নত।

বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তি
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান যুক্ত হয় ২০১৩ সালে। তৎকালীন সময়ে আধুনিক প্রশিক্ষণ ও কার্যকর অপারেশনের সক্ষমতার কারণে এই বিমানকে বহরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মোট ১৬টি এফ-৭ বিজিআই বিমান কিনেছিল বাংলাদেশ, যার মধ্যে ১২টি একক আসনের এবং ৪টি দ্বৈত আসনের (FT-7BGI) প্রশিক্ষণ বিমান ছিল। সেটিই ছিল এই বিমানের শেষ চালান। এরপর থেকে চীন এফ-৭ বিমানের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ও বৈশিষ্ট্য
এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটিকে বলা হয় "ফোর্থ জেনারেশন প্লাস" মানের একটি লাইট ও বহুমুখী ফাইটার। এতে রয়েছে আধুনিক গ্লাস ককপিট, মাল্টি-ফাংশন ডিসপ্লে (MFD), হেলমেট-মাউন্টেড টার্গেটিং সিস্টেম, এবং উন্নত রাডার সিস্টেম। এই বিমানে চীনের KLJ-6F রাডার ব্যবহৃত হয়, যা ৫৫ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত শত্রু শনাক্ত করতে পারে।

তাছাড়া, বিমানটিতে রয়েছে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন এবং আধুনিক অস্ত্র বহনের সুবিধা। এতে PL-5 ও PL-9 ইনফ্রারেড গাইডেড এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল ব্যবহার করা যায়। গতি সর্বোচ্চ ১.৮৫ মাখ (প্রায় ২,২৫০ কিমি/ঘণ্টা), যা এটিকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ক্ষমতাসম্পন্ন ফাইটার বানিয়েছে।

বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, সুদান, তানজানিয়া, মিশরসহ প্রায় ১২টিরও বেশি দেশে এফ-৭ সিরিজের বিভিন্ন সংস্করণ ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো এই বিমানকে বাজেট-বান্ধব কিন্তু কার্যকর একটি ফাইটার হিসেবে গ্রহণ করেছে।

অবসর
যদিও এফ-৭ বিজিআই ছিল নির্ভরযোগ্য, তবে বর্তমান যুগের যুদ্ধক্ষেত্রে ৪.৫ এবং ৫ম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলোর প্রভাবে এই ধরনের প্ল্যাটফর্ম পুরাতন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বর্তমানে আরও উন্নত যুদ্ধবিমান (যেমন, JF-17 Block III বা সম্ভাব্য Su-30SME বা Rafale) সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে।

যুদ্ধবিমানটির আনুমানিক মূল্য
প্রতিটি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানের আনুমানিক মূল্য ছিল প্রায় ৮-১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুলনামূলকভাবে এটি অত্যন্ত সাশ্রয়ী ছিল, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি চমৎকার সমাধান হিসেবে কাজ করেছে। 

এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর বিকল্প হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা বা খারাপ দিকও ছিল, যেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিচে এর প্রধান খারাপ দিকগুলো তুলে ধরা হলো:

প্রযুক্তিগত পুরনোত্ব: এফ-৭ বিজিআই মূলত সোভিয়েত মিগ-২১-এর উন্নত সংস্করণ। যদিও এতে আধুনিক কিছু যন্ত্রাংশ ও ইলেকট্রনিক্স যুক্ত করা হয়েছিল, তারপরও এর মৌলিক নকশা ছিল ১৯৬০-এর দশকের। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে স্টেলথ, নেটওয়ার্কড ও মাল্টিরোল ক্যাপাবিলিটির ঘাটতি ছিল।

সীমিত অস্ত্র বহনের ক্ষমতা: এফ-৭ বিজিআই একবারে সীমিত সংখ্যক অস্ত্র বহন করতে পারে এবং এতে ভারী বা দীর্ঘ-পাল্লার গাইডেড মিসাইল বা স্মার্ট বোমা ব্যবহারের সক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। আধুনিক যুদ্ধবিমানের তুলনায় এটি টেকনিক্যালি পিছিয়ে ছিল।

রাডার ও সেন্সরের সীমাবদ্ধতা: যদিও এতে KLJ-6F রাডার ছিল, তবে তা আধুনিক AESA রাডারের তুলনায় অনেক কম কার্যকর। শত্রু শনাক্তকরণ, ট্র্যাকিং এবং খারাপ আবহাওয়ায় টার্গেট লক করার ক্ষেত্রে এর পারফরম্যান্স সীমিত ছিল।

কম রেঞ্জ: এই যুদ্ধবিমানের ফ্লাইট রেঞ্জ এবং ‘কমব্যাট এন্ডিউরেন্স’ কম ছিল। একটানা দীর্ঘ সময় টহল বা অভিযানে অংশ নেওয়া এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে এটি শুধুমাত্র সীমিত দূরত্বে কার্যকর ছিল।

নন-স্টেলথ ডিজাইন: এই বিমানটি স্টেলথ প্রযুক্তি সমর্থন করে না। অর্থাৎ শত্রুর রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল, যা আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে বড় একটি দুর্বলতা।

একক ইঞ্জিনের ঝুঁকি: এই যুদ্ধবিমান একক ইঞ্জিনবিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে পুরো মিশন ব্যর্থ হওয়ার এবং পাইলটের জীবন হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকত।

অপারেশনাল খরচ বনাম কার্যকারিতা: যদিও এটি তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহ বেশ ব্যয়বহুল। সেই তুলনায় এটি যতটা ‘কমব্যাট রেডি’ থাকার কথা, তা অনেক সময় সম্ভব হতো না।

মাল্টিরোল সীমাবদ্ধতা: এটি প্রধানত একটি এয়ার-টু-এয়ার ফাইটার হিসেবে কার্যকর ছিল, কিন্তু আধুনিক মাল্টিরোল ফাইটারের মতো ভূমি-আক্রমণ, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বা রিকনেসান্সে এর ক্ষমতা সীমিত ছিল।

এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি এক দশক ধরে বাংলাদেশ আকাশ প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, এটি ছিল এক ধরনের ‘ট্রানজিশনাল প্ল্যাটফর্ম’। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, অস্ত্র বহনের ক্ষমতা এবং অপারেশনাল রেঞ্জের ঘাটতির কারণে আজকের যুদ্ধক্ষেত্রে এটি অপ্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়েছে। সময়োপযোগী আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে এর অবসর অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী ছিলো।