
আধুনিক যুদ্ধ কৌশলে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। যেকোনো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অপরিহার্য। এটি শত্রু বিমান, ড্রোন এবং ব্যালিস্টিক মিসাইলের মতো আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর দেশ উন্নত প্রযুক্তির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে। নিচে বিশ্বসেরা সাতটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সেগুলোর কার্যকারিতা তুলে ধরা হলো:
S-400
রাশিয়ার তৈরি S-400 Triumf বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও বহুমুখী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি ৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ধ্বংস করতে সক্ষম। এই সিস্টেম একইসাথে যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল ধ্বংস করতে পারে। ২০০৭ সালে রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়া এই অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা শিল্পপ্রতিষ্ঠান Almaz-Antey। এই ব্যবস্থা একইসঙ্গে যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং ক্রুজ মিসাইল ধ্বংস করতে পারে। উন্নত রাডার সিস্টেমের সাহায্যে এটি একসাথে ৮০টি লক্ষ্যবস্তু ট্র্যাক করে এবং ৩৬টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
- একসাথে ৮০টি লক্ষ্যবস্তু ট্র্যাক করতে পারে
- ৩ মিনিটের মধ্যে মোতায়েনযোগ্য
- চীনের পর ভারত, তুরস্ক এবং সৌদি আরব ইতোমধ্যে এই সিস্টেম কিনেছে
THAAD
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি THAAD (Terminal High Altitude Area Defense) বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর একটি। শত্রুর ব্যালিস্টিক মিসাইল আকাশে উৎক্ষেপণের পর সেটি লক্ষ্যবস্তুর দিকে নামার সময়ই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম এই প্রযুক্তি। এই ব্যবস্থায় যুক্ত রয়েছে অত্যাধুনিক AN/TPY-2 radar, যা ১,০০০ কিমি পর্যন্ত দূরের লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম।
কার্যকারিতা:
- ৪০-১৫০ কিমি (পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরে) নিখুঁত লক্ষ্যভেদ ক্ষমতা
- রাডার প্রযুক্তিতে উন্নত AN/TPY-2 রাডার ব্যবহৃত
- দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং ইসরায়েলেও মোতায়েন রয়েছে
Iron Dome
আইরোন ডোম মূলত স্বল্প পাল্লার রকেট ও মর্টার প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়। এটি শহর, স্থাপনা বা সেনা ঘাঁটিকে রক্ষা করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। ইসরায়েল প্রতিনিয়ত এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে হামাস বা অন্যান্য সংগঠনের রকেট হামলা প্রতিহত করতে।
বৈশিষ্ট্য:
- ৪ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে সক্ষম
- প্রতিটি ব্যাটারি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হুমকি শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেয়
- ৯০% এর বেশি সফলতার হার
Patriot PAC-3
প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা হলো বহুল ব্যবহৃত এবং বহুবার যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণিত একটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। PAC-3 সংস্করণটি বিশেষ করে ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরোধে উন্নত।
বিশেষত্ব:
- যুদ্ধক্ষেত্রে বহুবার সফলভাবে ব্যবহৃত
- বিভিন্ন ধরনের মিসাইল প্রতিরোধে সক্ষম
- জার্মানি, জাপান, সৌদি আরব ও পোল্যান্ডের মতো দেশ এই সিস্টেম ব্যবহার করে
Aegis Combat System
এজিস কমব্যাট সিস্টেম হলো একটি সমন্বিত নৌ-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যা ইউএস নেভি এবং ন্যাটো সদস্যরা ব্যবহার করে। এটি জাহাজভিত্তিক রাডার, কমান্ড কন্ট্রোল এবং SM সিরিজের মিসাইল দিয়ে কাজ করে।
কার্যকারিতা:
- সমুদ্র থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা পরিচালনা করে
- ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল প্রতিরোধে সক্ষম
- Aegis Ashore নামে স্থলভিত্তিক সংস্করণও রয়েছে
David’s Sling
ডেভিড সিলিং ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের যৌথভাবে তৈরি একটি মধ্যম পাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি Iron Dome ও Arrow সিস্টেমের মাঝামাঝি অবস্থানে কাজ করে।
বৈশিষ্ট্য:
- ৪০-৩০০ কিমি দূরত্বের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে সক্ষম
- উন্নত সেন্সর ও ইলেকট্রনিক জ্যামিং রোধে সক্ষম
HQ-9
চীনের HQ-9 সিস্টেমটি অনেকটা S-300 এর মতন ডিজাইন করা হলেও চীন নিজস্ব প্রযুক্তিতে এটি আরও উন্নত করেছে। এটি মাঝারি ও দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল প্রতিরোধে সক্ষম।
কার্যকারিতা:
- ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে সক্ষম
- মাল্টি-লেয়ার প্রতিরক্ষা গঠন করতে পারে
- পাকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান এটি ব্যবহার করছে
বর্তমান বৈশ্বিক নিরাপত্তা বাস্তবতায় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শুধু একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয় বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত সক্ষমতার প্রতীক। রাশিয়ার S-400 থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের THAAD ও ইসরায়েলের Iron Dome—প্রতিটি সিস্টেমই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও কার্যকারিতায় অনন্য। এসব প্রযুক্তি যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, তেমনি কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রতিপক্ষের উপর চাপ তৈরি করে। ভবিষ্যতের যেকোনো সম্ভাব্য সংঘাতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং মোতায়েনই একটি দেশের নিরাপত্তার মূল ভিত্তি হয়ে উঠবে। তাই প্রতিরক্ষা বাজেট ও কৌশল নির্ধারণে এসব প্রযুক্তির গুরুত্ব দিন দিন আরও বেড়েই চলেছে।