
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে, যার একটি বড় অংশ যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সস্তা শ্রম এবং দ্রুত উৎপাদনের সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের ৩৫% শুল্ক আরোপ এই শিল্পকে এক কঠিন পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেবে।
শুল্ক বৃদ্ধির কারনে বাংলাদেশি পণ্যের দাম মার্কিন বাজারে তুলনামূলকভাবে বেড়ে যাবে। এর ফলে, মার্কিন ক্রেতারা অন্যান্য সস্তা উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। ইতিমধ্যেই করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্প চাপের মুখে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে শুল্ক আরোপ হলে অনেক ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে বেকারত্বের হার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক পণ্যবাণিজ্য ছিলো প্রায় ১০.৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৮.৪ বিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশের রপ্তানি এবং মাত্র ২.২ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয় সেদেশ থেকে। এই রপ্তানি আয়ের মধ্যে পোশাক রপ্তানি ছিল প্রায় ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার। এই তথ্য থেকে পরিষ্কার যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার। ট্রাম্প প্রশাসনের ৩৫% শুল্ক আরোপ কেন এত হুমকি স্বরূপ, তা এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
দেশের পোশাক শিল্প মালিকরা এই বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এমনিতেই গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং কাঁচামালের উচ্চমূল্যের কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। এর ওপর যদি শুল্ক আরোপ হয়, তাহলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি আরও যোগ করেন, আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, এই বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা দ্রুত বাড়ানোর জন্য।
শুধু পোশাক শিল্প নয়, বিদেশি ওষুধের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। বাংলাদেশের উদীয়মান ওষুধ শিল্পও ট্রাম্পের শুল্ক নীতির সম্ভাব্য শিকার হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। মানসম্মত জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন এবং তুলনামূলক কম মূল্যের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশি ওষুধের একটি সম্ভাবনাময় বাজার।
ওষুধ শিল্পের একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের ওষুধ শিল্প এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে এর সম্ভাবনা অপরিসীম। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে যদি এই অগ্রগতি ব্যাহত হয়, তাহলে তা দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারকে এখনই এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে সম্ভাব্য শুল্ক আরোপের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তাদের অবহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিকল্প বাজার খোঁজার ওপর জোর দিতে হবে। ইউরোপ, জাপান, কানাডা ছাড়াও অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ অন্বেষণ করতে হবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে হবে এবং উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদান করতে হবে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলাদেশের পণ্য বহুমুখীকরণ করা। শুধু পোশাক ও ওষুধের ওপর নির্ভর না করে, আইটি, চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এতে করে যেকোনো একটি দেশের শুল্ক নীতির ওপর নির্ভরতা কমবে এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল হবে।
ট্রাম্পের ঘোষিত ৩৫% শুল্ক সামনের দিনগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে। বিশেষ করে পোশাক ও ওষুধ খাত, যা দেশের লাখো মানুষের জীবিকা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম বড় বাজার হওয়ায়, এখানকার যেকোনো নীতিগত পরিবর্তনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে। তাই সময়মতো কূটনৈতিক তৎপরতা, নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং বাজার বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা জরুরি। একই সঙ্গে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা ও শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে দেশের উৎপাদন ও রপ্তানি প্রবাহ স্থিতিশীল রাখা যায়।