
সম্প্রতি ডলারের মূল্য কমে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা দেশের অর্থনীতিতে এক নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দাম কমেছে ২ টাকা ৯০ পয়সা । বৃহস্পতিবার বেশিরভাগ ব্যাংক রেমিট্যান্সের ডলার কেনার ক্ষেত্রে ১২০ টাকা রেট অফার করেছে। যদিও কিছু ব্যাংক দাবি করেছে, তারা ১২০ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত কিনেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি কমে যাওয়াই এই দরপতনের মূল কারণ। যদিও সাময়িকভাবে ডলার সস্তা হওয়াকে অনেকেই ভালো লক্ষণ হিসেবে দেখছেন, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের শিল্প খাত ও কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্প খাতে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিতে প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিক্স এবং নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও উপকরণের আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক মন্দা, অভ্যন্তরীণ বাজারে অস্থিরতা এবং উচ্চ সুদের হার—সব মিলিয়ে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে তেমন একটা আগ্রহী না। ফলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমে যাচ্ছে। এর ফলে ডলারের চাহিদা কমে অনেক কমে গেছে। এতে আমদানিকারকরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও এই দরপতনের পেছনের বাস্তবতা অনেক বেশি উদ্বেগজনক। ডলারের চাহিদা কমে যাওয়া কোনো ইতিবাচক বার্তা নয়, যদি এর পেছনে আমদানি হ্রাস থাকে। কারণ এটি শিল্প উৎপাদনের সংকোচনের ইঙ্গিত দেয়, যার ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
বাংলাদেশের উৎপাদন ও রপ্তানি নির্ভর খাতগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক অন্যতম। এই খাতে বড় পরিসরে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু উদ্যোক্তারা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে অর্ডার কমে যাওয়া, উচ্চ সুদের হার, ও ডলারের অস্থিরতা—সব মিলিয়ে তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) একজন পরিচালক জানান, আমরা যন্ত্রপাতি আমদানির বিষয়ে এখন অনেক সাবধানতা অবলম্বন করছি। কারণ আমরা জানি না আগামী ৬ মাসেও রপ্তানি পরিস্থিতি কেমন থাকবে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে নতুন কারখানা স্থাপন বা বিদ্যমান কারখানায় উৎপাদন বাড়ানোর প্রবণতা কমবে, যা সরাসরি কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ শিল্প খাতের উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, পাট, চামড়া, ও প্লাস্টিক শিল্পে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে ধীরগতির ফলে নতুন নিয়োগ অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় অনেক কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে রপ্তানি আয়ের ওপর।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
ডলারের দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি একদিকে যেমন সাময়িক স্বস্তি এনে দিয়েছে, অন্যদিকে এটি দেশের শিল্প খাত ও কর্মসংস্থানে একটি দীর্ঘমেয়াদি হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি হ্রাস শিল্প প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে, যার ফলে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও সংকুচিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার, উদ্যোক্তা, ও নীতিনির্ধারকদের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।