ঢাকা     ০৪ জুলাই ২০২৫ ||  ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

Biz Tech 24 :: বিজ টেক ২৪

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

সাইফুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ৩ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত তৈরি পোশাক (গার্মেন্ট) শিল্প চলতি অর্থবছরেও রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষভাগে এসে এই খাত থেকে আয় দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশই এসেছে এই একটি খাত থেকে।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো অক্ষুণ্ন থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পটি কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, পণ্যের শুল্ক জটিলতা এবং শ্রমিক খাতে অস্থিরতা এই শিল্পকে কিছুটা চাপে ফেলেছে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসে ঈদের ছুটির কারণে রপ্তানি প্রবাহে সাময়িক ভাটা দেখা দিয়েছে। 

পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্য। তবে বর্তমানে বিকল্প ও উদীয়মান বাজারেও বাংলাদেশ প্রবেশ করছে। বিশেষ করে ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো এবং চিলির মতো দেশে রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব অপ্রচলিত বাজারগুলোতে গার্মেন্ট রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় নিশ্চিত করেছে। ভারতের বাজারে রপ্তানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক কাঠামো পরিবর্তন এবং ভারতের আমদানি নীতিতে কড়াকড়ি কিছুটা উদ্বেগ তৈরি করেছে। তবুও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে মানসম্মত পণ্য সরবরাহের কারণে বাংলাদেশ এখনো অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ এখনো বিশাল সম্ভাবনার অধিকারী। দেশের ২৬০টির বেশি গ্রিন ফ্যাক্টরি বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, যার মধ্যে বহু প্রতিষ্ঠান প্ল্যাটিনাম ও গোল্ড সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত। টেকসই উৎপাদন পদ্ধতি, শ্রমিক নিরাপত্তা এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। এছাড়া, প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন, স্বয়ংক্রিয় মেশিনারিজ ও দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গার্মেন্ট পণ্যের গুণমান উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

তবে এসবের মধ্যেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে ২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা (GSP) হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে দেশের গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস ও পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে।

এছাড়া শ্রমিকদের বেতন কাঠামো, কর্মপরিবেশ, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহজনিত সমস্যা এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর চাহিদা অনুযায়ী মান বজায় রাখাও এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতের জন্য গার্মেন্ট খাতকে টেকসই করতে হলে নিম্নলিখিত দিকগুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে—

  •     বাজার বৈচিত্র্য: নতুন রপ্তানি বাজার খুঁজে বের করা এবং বিদ্যমান বাজারে অবস্থান আরও মজবুত করা।
  •     প্রযুক্তি বিনিয়োগ: আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু করা।
  •     শ্রমিক কল্যাণ: শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
  •     ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইন্ডাস্ট্রি: দেশেই কাঁচামাল উৎপাদনের সক্ষমতা গড়ে তোলা।
  •     পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ: কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা বাড়ানো।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে। শ্রমনির্ভর এই খাত শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎসই নয় বরং লাখো মানুষের জীবিকা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট ও প্রতিযোগিতার মাঝেও বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত রেখেছে। তবে টিকে থাকতে হলে সময়োপযোগী নীতি গ্রহণ, প্রযুক্তিনির্ভরতা, শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিতকরণ এবং বৈচিত্র্যময় বাজারে প্রবেশ জরুরি। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই ও সবুজ শিল্পে রূপান্তর ঘটাতে পারলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বিশ্ববাজারেও একটি আদর্শ মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।