
স্মার্টফোন আজ শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয় বরং আধুনিক জীবনের অপরিহার্য অংশ। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে এই খাত, আর সেই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে—তা নির্ধারিত হচ্ছে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, দামের প্রতিযোগিতা, সফটওয়্যার একীকরণ এবং বাজার বিস্তারের কৌশলের ওপর। ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে স্মার্টফোন বাজারের রাজত্ব নিয়ে চলছে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার সামসাং, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপল এবং চীনের শাওমি-সহ একাধিক ব্র্যান্ড নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে নানামুখী কৌশল গ্রহণ করছে।
দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক টেক কোম্পানি সামসাং দীর্ঘদিন ধরে স্মার্টফোন বাজারে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুর দিকেও গার্টনার, ক্যানালিস ও আইডিসি-সহ বিভিন্ন বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সামসাং স্মার্টফোন বাজারের ২০ থেকে ২২ শতাংশ শেয়ার ধরে রেখেছে, যা তাকে বিশ্বসেরা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সামসাংয়ের সাফল্যের পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। গ্যালাক্সি S ও Z সিরিজের প্রিমিয়াম ফোন থেকে শুরু করে A ও M সিরিজের বাজেট ফ্রেন্ডলি ফোন। যা সব শ্রেণির গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে পারে। ফোল্ডেবল ডিসপ্লে, উন্নত ক্যামেরা সেন্সর, AI ফিচার, One UI অপারেটিং সিস্টেম ইত্যাদির মাধ্যমে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে প্রতিষ্ঠানটি বেশ এগিয়ে। প্রায় সব বড় বাজারে সামসাংয়ের সরাসরি উপস্থিতি এবং তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা একে আরও শক্তিশালী করেছে।
সামসাংয়ের অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে চীনা প্রতিষ্ঠান শাওমি। ২০২৪ ও ২০২৫ সালের বাজার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শাওমি প্রায় ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বাজার ধরে রেখেছে। মধ্যম দামের আধুনিক স্পেসিফিকেশন, আক্রমণাত্মক মার্কেটিং এবং অনলাইন ভিত্তিক বিক্রির মাধ্যমে শাওমি দ্রুত বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
শাওমি ছাড়াও চীনা ব্যান্ড অপো, ভিভো ও ট্রানশন (যার অন্তর্ভুক্ত ইনফিনিক্স ও টেকনো) আফ্রিকা, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। এই ব্র্যান্ডগুলো মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজেট ফ্রেন্ডলি স্মার্টফোন ব্যবহাকারীদের লক্ষ্য করে ব্যবসা বিস্তার করেছে।
যদিও প্রিমিয়াম সেগমেন্টের রাজা অ্যাপলের শেয়ার তুলনামূলক কিছুটা কম তবে এটি এখনো সবচেয়ে বেশি লাভজনক স্মার্টফোন ব্র্যান্ড। iPhone এর উচ্চমূল্য, নিখুঁত হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার সমন্বয় এবং শক্তিশালী একো-সিস্টেম অ্যাপলকে প্রিমিয়াম মার্কেট সেগমেন্টে শীর্ষে রেখেছে। ২০২৪ সালের শেষে অ্যাপল কিছু সময়ের জন্য সামসাংকে টপকে গিয়েছিলো। বিশেষ করে iPhone ১৫ সিরিজ বাজারে আসার পর। তবে বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে আসায় অ্যাপল আবার দ্বিতীয় অবস্থানে নেমে গেছে।
চলতি বছরে স্মার্টফোন বাজারে নতুন প্রযুক্তির প্রভাব বাড়ছে—এর মধ্যে AI ফিচার, স্যাটেলাইট কানেকটিভিটি এবং ফোল্ডেবল স্ক্রিন। চীনের হুয়াওয়ে নতুন করে বাজারে ফিরতে চাচ্ছে তাদের নিজস্ব চিপসেট ও HarmonyOS দিয়ে। যদিও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এখনো প্রতিষ্ঠানটির জন্য বড় বাধা।
এদিকে, হোনর-এর মতো চীনা ব্র্যান্ডগুলো AI ও ফোল্ডেবল প্রযুক্তিতে আগ্রাসী বিনিয়োগ করছে। এছাড়া ভারত ও আফ্রিকার মতো উদীয়মান বাজারে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হচ্ছে।
বিশ্বের স্মার্টফোন বাজার এখন আর শুধু ডিভাইস বিক্রির প্রতিযোগিতা নয় বরং এটি হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, কৌশলগত বাণিজ্য ও ভোক্তা মনস্তত্ত্বের যুদ্ধক্ষেত্র। সামসাং তার বৈচিত্র্যময় পণ্যসীমা, বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক এবং টেকসই ব্র্যান্ড ইমেজের মাধ্যমে এখনও শীর্ষে রয়েছে। তবে অ্যাপল তাদের নিজস্ব ইকোসিস্টেম এবং প্রিমিয়াম ব্যবহারকারীদের জন্য সেরা অভিজ্ঞতা দিয়ে বাজারের একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছে। অপরদিকে, শাওমি, অপো, ভিভো এবং অন্যান্য চীনা ব্র্যান্ড বাজেট ও মিড-রেঞ্জ গ্রাহকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। স্মার্টফোনের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে যারা নতুন প্রযুক্তি যেমন—এআই, ফোল্ডেবল ডিসপ্লে, স্যাটেলাইট কানেকটিভিটি ও সফটওয়্যার ইন্টিগ্রেশনে সবচেয়ে দ্রুত ও কার্যকরভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে তাদের মাধ্যমেই।